জননেতা মফিজ আলীর ১৭-তম মৃত্যুবার্ষিকী পালন
প্রকাশিত হয়েছে : ১০ অক্টোবর ২০২৫, ৮:৩৩ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক::
বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি, মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাবেক সভাপতি, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এনডিএফ সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা, সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ বিরোধী নেতা, ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, প্রখ্যাত চা-শ্রমিক নেতা মফিজ আলী-এর ১৭-তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ১০ অক্টোবর শুক্রবার বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করা হয়। এদিন সকাল সাড়ে ৯ টার সময় বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ, জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট, বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ, গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়ন, চা শ্রমিক সংঘ, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন, স’মিল শ্রমিক সংঘসহ বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গের পক্ষ থেকে কমলগঞ্জ উপজেলার শ্রীসূর্য-ধূপাটিলাস্থ প্রয়াত নেতার সমাধিতে পুস্পস্তবক অর্পণ এবং প্রয়াত নেতার অসমাপ্ত কাজকে অগ্রসর করে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে শপথ গ্রহণ করা হয়। পরে স্থানীয় মাঠে বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির উদ্যোগে এক আলোচনা সভা অনুষ্টিত হয়। সংগঠনের জেলা সভাপতি মোঃ নুরুল মোহাইমীনের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক রজত বিশ্বাসের পরিচালনায় অনুষ্টিত আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি মৌলভীবজাার জেলা কমিটির যুগ্ম-আহবায়ক রমজান আলী পাখি, ধ্রুবতারা সাংস্কৃতিক সংসদ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সম্পাদক অমলেশ শর্ম্মা, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন সংঘ মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সহ-সভাপতি মোঃ সোহেল মিয়া, হোটেল শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি আবুল কালাম, রিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি মোঃ গিয়াস মিয়া, চা শ্রমিক সংঘের সাধারণ সম্পাদক হরিনারায়ন হাজরা, হোটেল শ্রমিকনেতা জামাল মিয়া, প্রবীণ চা-শ্রমিকনেতা স্যামুয়েল বেগম্যান, রিকশা শ্রমিকনেতা মোঃ মোস্তফা মিয়া প্রমূখ। এছাড়াও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সভাপতি কবি শহীদ সাগ্নিক অসুস্থ্য অবস্থায় মফিজ আলীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে মোবাইল মাধ্যমে বার্তা পাঠান।
সভায় বক্তারা বলেন আমৃত্যু সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ বিরোধী মফিজ আলী শৈশবেই প্রত্যক্ষ করেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা। আর জননেতা মফিজ আলীর মৃত্যুর ১৭ বছর পালন করা হচ্ছে তখন সমগ্র বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বন্টন নিয়ে বাণিজ্য যুদ্ধ, মুদ্রা যুদ্ধ, স্থানিক ও আঞ্চলিক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের জোট ন্যাটো এবং সাম্রাজ্যবাদী রাশিয়া ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনের নেতৃত্বে পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের মদতপুষ্ঠ ইসরাইল প্যালেস্টাইনে হামাস নির্মূলে গত দুই বছর থেকে নির্বিচারে আগ্রাসন ও গণহত্যা চালিয়ে ৬৭ হাজারের বেশি নিরীহ নারী, শিশু, বৃদ্ধকে হত্যা করে সমগ্র গাজা দখল করে প্রমোদনগরী গড়ে তোলার মার্কিন পরিকল্পনা কার্যকরী করতে সচেষ্ঠ। ইউক্রেন যুদ্ধ, ইসরাইল কর্তৃক প্যালেস্টাইনে আগ্রাসন ও গণহত্যা, পাহেলগাম ঘটনাকে কেন্দ্র করে পাক-ভারত যুদ্ধ, ইসরাইল-ইরান যুদ্ধ ইত্যাদি ঘটনা বিচ্ছিন্ন বিষয় না। বরং তা পুঁজি ও শক্তি অনুপাতে বাজার ও প্রভাব বলয় পুনর্বন্টন নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বাণিজ্যযুদ্ধ, মুদ্রাযুদ্ধ, প্রযুক্তি যুদ্ধ, আঞ্চলিক ও স্থানিক যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় পারমানবিক অস্ত্রের ব্যবহারসহ তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিপদ বৃদ্ধি করে চলেছে। আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে ভূরাজনৈতিক ও রণনীতিগত গুরুত্বপূর্ণ মালাক্কা প্রণালী সংলগ্ন বঙ্গোপসাগরীয় নয়াউপনিবেশিক আধাসামন্ততান্ত্রিক বাংলাদেশকে নিয়ে প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে চলেছে। এপ্রেক্ষিতে ৫ আগষ্ট’২৪ শহুরে ছাত্র জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাঁর আরও বিশ্বস্থ দালাল ড. ইউনুসকে ক্ষমতাসীন করে এই সময়ে শুল্ক আলোচনায় প্রভূর পরিকল্পনায় মানবিক করিডোর প্রদান, জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপন, চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমোরিং কনটেইনার টার্মিনাল মার্কিন নৌবাহিনী সাথে সম্পর্কিত ডিপি ওয়ার্ল্ডকে ইজারা প্রদান, স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট চালু, মার্কিন সেনা উপস্থিতি, ধারাবাহিক মার্কিন সেনাবাহিনীর মহড়া ও প্রশিক্ষণ তৎপরতা, মার্কিনের পক্ষে যুদ্ধে সম্পৃক্ত করা, আইপিস প্লাসে যুক্ত করা ইত্যাদি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট-এনডিএ চুক্তি সম্পাদন করে। প্রতিপক্ষ সাম্রাজ্যবাদী চীন-রাশিয়াও স্বীয় লক্ষ্যে নানামূখী তৎপরতা চালাচ্ছে। বাজার ও প্রভাব বলয় বিস্তার নিয়ে আন্তঃসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বে উভয়পক্ষের আগ্রাসীযুদ্ধে সম্পৃক্ত করার পাঁয়তারা বিরুদ্ধে এদেশের শ্রমিক-কৃষক-জনতা, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাড়াতে হবে।
বক্তারা আরও বলেন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্দ্ধগতির এই সময়ে বাজারদরের সাথে সংগতিপূর্ণ মজুরি না পাওয়া, কাজ শেষে মজুরি-বোনাস প্রাপ্তির অনিশ্চয়তা, শিল্প কারখানা বন্ধ, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীনতা সর্বোপরি জনজীবনের সমস্যা-সংকট বৃদ্ধি পেয়ে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়ছে। মার্কিনের বিশ্বস্থ দালাল ড. ইউনুসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন হয়ে মুখে অনেক কথা বললেও গত এক বছরের জনজীবনের সংকট না কমে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। সাম্রাজ্যবাদী সংস্থা আইএমএফ’র নির্দেশে কৃষিতে ভর্তুকি প্রত্যাহারে সরকার আবার সার উৎপাদনে গ্যাসের মূল প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে ৩০ টাকা করতে তৎপরতা চালাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠোপোষকতায় অবাধ লুটপাটের কারণে ধনী ও গরীবের বৈষম্য আরও বেড়েছে। ব্যাংকিং সেক্টরে লুটপাটের কারণে খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে ৫ কোটি টাকার ওপরে। খেলাপি ঋণের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাড়ায় প্রায় ১৩ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা। সাম্রাজ্যবাদ ও তার এদেশীয় দালালদের লুটপাটের কারণে দেশের আর্থিক খাত দেউলিয়াত্বের ঝুঁকিতে রয়েছে। গত এক বছরে প্রায় ৪শত গার্মেন্টস কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার, ৪০ টি বেশি চা-বাগানের শ্রমিকদের মজুরি-বোনাস পরিশোধ অনিয়মিত; হকার ও ব্যাটারি চালিত রিকশা, ইজিবাইক উচ্ছেদ তৎপরতা ইত্যাদি কারণে শ্রমিক ও শ্রমজীবী জনগণের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। উপরন্তু শ্রমিকরা ছাঁটাই নির্যাতন ও বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলনে নামলে সরকার মালিকদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে শ্রমিক আন্দোলন দমনে পূর্বের স্বৈরাচারী কায়দায় রাষ্ট্রীয় বাহিনী লেলিয়ে দিয়ে শ্রমিক হত্যা করছে। দীর্ঘদিন থেকে চা-শিল্পের শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা হচ্ছে না, উপরন্তু আইনগত অধিকার হতেও চা-শ্রমিকদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। এছাড়াও হোটেল, স’মিল, রাইস মিল, নির্মাণ, মুদ্রণসহ বিভিন্ন সেক্টরে সরকার যে মজুরি ঘোষণা করেছে মালিকরা সেই মজুরিও পরিশোধ করে না। শ্রমিকরা যাতে সংগঠিতভাবে ন্যায্য মজুরি-বোনাস, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তাসহ অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারে সেজন্য মালিকদের স্বার্থরক্ষাকারী রাষ্ট্রের সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনী দিয়ে শ্রমিক আন্দোলন দমনের অপচেষ্টার পাশাপাশি শ্রমআইনের অর্জিত অধিকার সংকোচনের তৎপরতা চালাচ্ছে। মার্কিনসহ পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদীদের নির্দেশনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তী সরকার শ্রমআইনের সংশোধনের উদ্যোগ নেয়। কিন্ত মালিকদের চাপের মুখে সরকার ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে এমন শর্ত আরোপ করার তৎপরতা চালাচ্ছে যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে শতভাগ শ্রমিকের সমর্থনের শর্ত এবং অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিদ্যমান ২০ শতাংশের চেয়ে বেশি সমর্থনের শর্ত জুড়ে দিয়ে কার্যত ট্রেড ইউনিয়ন গঠন আরও কঠিন করার পাঁয়তারা চলছে। এছাড়াও শ্রমআইনের বিদ্যমান সিবিএ মর্যাদা বাতিল করে মালিকদের নিকট দাবি পেশ করার সুযোগও সংকোচিত করা হচ্ছে। তাই ন্যূনতম মূল মজুরি ৩০ হাজার টাকা ঘোষণা, দ্রব্যমূল্য কমানো ও সর্বস্তরে রেশন চালু, বিদ্যমান শ্রমআইনের ২৩ ও ২৬ ধারাসহ শ্রমিকস্বার্থ বিরোধী সকল ধারা বাতিল করে গণতান্ত্রিক শ্রমআইন প্রণয়ন, অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জাতীয় ভিত্তিক শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে অগ্রসর হতে হবে।
বক্তারা মফিজ আলীর জীবনের উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন মফিজ আলী ছাত্র জীবন থেকে প্রগতিশীল রাজনীতির ধারায় সম্পৃক্ত হয়ে ছাত্রআন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলনে আত্ননিয়োগ করে তাঁর জীবনের প্রায় পুরোটা সময় নিজের পরিবার-পরিজন ও আত্মপ্রতিষ্ঠার চিন্তা না করে সাধারণ মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। ৬০-এর দশকে সংশোধনবাদী তিন শান্তির তত্ত্ব নিয়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক শুরু হলে আমাদের দেশে কমরেড আবদুল হক, কমরেড অজয় ভট্টাচার্য্য প্রমূখ নেতৃবৃন্দ মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পতাকা উর্দ্ধে তুলে ধরে মতাদর্শগত লড়াই চালান। ফলশ্রুতিতে ১৯৬৫ সালে পার্টি বিভক্ত হয়ে গেলে মফিজ আলী মার্কসবাদ-লেনিনবাদের পক্ষে অবস্থান নেন। তিনি মাঠের কর্মী হিসেবে, জননেতা হিসেবে শোষিত নির্যাতিত শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে যেমন নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন, তেমনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে সংশোধনবাদ-সুবিধাবাদীদের মুখোশ উন্মোচন করেছেন। দীর্ঘ ৬০ বছরের বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে তিনি ৭ বার কারাবরণ করেন। ২০০৮ সালে ১০ অক্টোবর সংগ্রামী এই জননেতা ৮১ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।






