চা বাগানে পাঠশালা
প্রকাশিত হয়েছে : ৪ অক্টোবর ২০১৫, ৪:৫২ অপরাহ্ণ
পূর্বদিক রিপোর্ট ::
তের বছর ধরে মৌলভীবাজার জেলার ৮টি চা বাগানে অবহেলিত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের অক্ষরজ্ঞান দিতে নিরলসভাবে কাজ করছেন কবি সূর্যদাস তপন। এরই মধ্যে গত ৫ বছর ধরে তিনি মাজডিহি ও প্রেমনগর চা বাগানে দুইটি প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে আসছেন। একটি পাকা ঘরে ও অন্যটি খোলা আকাশের নিচে। প্রেমনগর চা বাগানের শিশুরা খোলা আকাশের নিচে পড়ালেখা করে। বৃষ্টি বাদলের দিনে তাই বিদ্যালয়টি বন্ধ থাকে। নিজের টাকা খরচ করে তিনি বই, খাতা, কলম, পেন্সিল দিয়ে আসছেন। কিন্তু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকায় তার এই বিদ্যালয়গুলোতে কোন ধরনের অনুদান তিনি পাচ্ছেন না।
কবিতা লেখেন, ক্যামেরাও চালান সূর্যদাস তপন। সময় পেলেই ছুটে যেতেন চা বাগানের সবুজ প্রকৃতির কাছে। একদিন বাগানে ঘুরছেন। হঠাৎ তার খেয়ালে আসলো, পাঠশালায় পড়ার সময়টিতে চা-বাগানের ধুলোমাখা পথে চা-শ্রমিক সন্তান একে অন্যের সাথে ঝগড়া করছে। কবি সূর্যদাস তপন অনুমান করেন এই শিশুরা বর্ণমালা থেকে অনেক দূরে। তাদের সামনে নিরক্ষরতার অন্ধকার জগত। সেই সময়টা ২০০১ সাল।
সেদিন বাগান থেকে ফিরে আসেন। ভিতরটা তার তোলপাড় হতে থাকে। কয়েক রাত তার এই শিশুদের জন্য কিছু করার ভাবনায় জেগে জেগে কেটে গেছে। পণ করে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পথে নামলেন। চা বাগানের শিশুদের বর্ণ শিখানোর কাজটা কাধে তুলে নিলেন। কিনলেন সীতানাথ বসাকের বেশ কয়েক কপি আদর্শলিপি। বাগানে গিয়ে শিশুদের মধ্যে আদর্শলিপি বিলি করলেন। তাদেরকে বর্ণ শিখানোর কাজ সেই থেকে তার শুরু। নিজের জমানো টাকায় প্রতি বৃহস্পতিবারে আদর্শলিপি কিনতেন। আর শুক্রবার তার ছবির স্টুডিও বন্ধ করে ছুটে যেতেন চা-বাগানের শিশুদের মাঝে। এভাবে চললো বেশ কিছুদিন। পরে একসময় মনে হলো, শিশুদের আকর্ষণ করার মতো বই চাই। আদর্শলিপির অনুসরণে ছাপা করলেন রঙচঙা বর্ণকূঁড়ি। এতে একটি বই ছাপা করতে খরচ হলো ১৮ টাকা। নিজের জমানো টাকা এবং কিছু বন্ধু-বান্ধব এই মুদ্রণে সহযোগিতা করলেন।
সেই ২০০১ থেকে বর্ণকূঁড়ি বিতরণ করেছেন মৌলভীবাজার জেলার দেওরাছড়া, মিরতিঙ্গা, ফুলছড়া, ভাড়াউড়া, মাইজদিহি, প্রেমনগর, গিয়াসনগর, ভুরভুরিয়া- এই আটটি চা-বাগানে। এছাড়া কাওয়াদীঘি হাওরপাড়ের কাশিমপুর এবং মৌলভীবাজার শহরের বিভিন্ন বস্তিতেও চললো তাঁর বই বিতরণ। একক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ হাজার বর্ণকূঁড়ি শিশুদের হাতে পৌঁছেছে। তার ব্যাগে সবসময় বর্ণকূঁড়ি থাকে। যেখানেই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের তাদের হাতে বই তুলে দেন।
তিনি ২০০৯ সাল থেকে জেলার প্রেমনগর ও মাইজডিহি চা-বাগানে বর্ণকূঁড়ি শিশু পাঠশালা গড়ে তুলেন। নিজেই শিশুদের অক্ষরের সাথে পরিচিত করাতে নামেন শিক্ষকের ভূমিকায়। এতে শিশুদের অভিভাবকরাও এগিয়ে আসেন। প্রচুর সাড়া পান। কিন্তু আর্থিক সংস্থান করতে না পারায় দুটি পাঠশালা মাস ছয়েক আগে বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন চলছে মাইজদিহি ও প্রেমনগর এই দুটি চা-বাগানে পাঠশালাটি। মাজডিহি বাগানে রোকসানা বেগম এবং প্রেমনগর চা বাগানে মীনা নায়েক এই দুজন শিক্ষিকা নিয়মিত পাঠ দিচ্ছেন শিশুদের। এই দুই পাঠশালায় শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। তাঁদের হাতে ঈদ ও পূজায় সামর্থমতো নতুন কাপড়, শীতে শীতবস্ত্র তুলে দেওয়া হয়। তিনি ভবিষ্যতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে বর্ণকূঁড়ি শিশু পাঠশালার পাশাপাশি বর্ণকূঁড়ি শিশু স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও বর্ণকূঁড়ি শিশু পাঠাগার গড়ে তোলার আকাঙ্খা মনে লালন করছেন। বর্ণকূঁড়ি শিশু পাঠাগারের মাধ্যমে তিনি চা বাগানের প্রতিটি শিশুকে বর্ণমালা শিখাতে চান। আর এবিষয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
সূর্যদাস তপন চা বাগানের অবেহিলত সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে আসছেন।
এটি সমাজসেবা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটিতে সরকারি অনুদান বা সুবিধা না পাওয়ার কারণ হলো, দেশের সরকারিভাবে পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতেই প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয় চালু আছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা পঞ্চানন বালা পূর্বদিককে বলেন, শিশুদের শিক্ষা দেওয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই যতটুকু সম্ভব সহযোগিতা করা হবে। #









