মৌলভীবাজারের আলোচিত ব্যবসায়ী রুবেল হত্যাকান্ড
ক্রেতা সেজে খুন, রক্তমাখা নোটে মিলল হত্যার সূত্র
প্রকাশিত হয়েছে : ১৮ আগস্ট ২০২৫, ৮:২০ অপরাহ্ণ

নিজস্ব প্রতিবেদক::
ওইদিন দোকানে আছরের নামাজ আদায় করছিলেন ব্যবসায়ী রুবেল। তখন দোকানে ক্রেতা সেজে প্রবেশ করে ২২বছর বয়সি জুহেল। তার পকেটে ধারালো ছুরি। রুবেল নামাজে দাড়ানো থাকায় ছুরি চালায়নি জুহেল। নামাজ শেষে রং দেখাতে জন্য বললে ব্যবসায়ী গডাউনের দিকে যান। সেখানে গিয়ে পকেটে থাকা ছুরি দিয়ে বুকে আঘাত করে জুহেল। চিল্লাচিল্লি আর ধস্তাধস্তি এক পর্যায়ে জুহেলের হাতের আঙুল কেটে যায়। সে একে একে পনেরোটি কোপ দেয় রুবেলকে। পরে দোকানের ক্যাশ থেকে এগারোশত টাকা নিয়ে অটোরিকশা করে হাসপাতালে গিয়ে নামে। তখন রিক্সা চালককে রক্তমাখা বিশটাকার নোট দেয় জুহের। সেই রক্তমাখা নোটে মিলল হত্যার সূত্র।
সোমবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে মৌলভীবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান পুলিশ সুপার এম. কে. এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন। হত্যার ১০ দিন পর পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে দোকানে প্রবেশ করে ব্যবসায়ী রুবেলকে হত্যা করেছে ২২ বছর বয়সী যুবক জুহেল মিয়া ওরফে জুয়েল ওরফে আলিফ।
পুলিশ সুপার জানান, গত ৭ আগস্ট সন্ধ্যা আনুমানিক ৬টা ৩৫ মিনিট থেকে ৭টার মধ্যে শমসেরনগর রোডের সিএনজি স্ট্যান্ডসংলগ্ন “এফ রহমান ট্রেডিং” দোকানে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। এ সময় দোকানে একাই ছিলেন ব্যবসায়ী রুবেল (৫৫)। নামাজ শেষে দোকানে ফিরতেই এক অজ্ঞাত যুবক ক্রেতা সেজে প্রবেশ করে। রঙ কেনার কথা বলে তাকে দোকানের ভেতরের অংশে নিয়ে যায়। সুযোগ বুঝে ধারালো ছুরি বের করে রুবেলের শরীরে একের পর এক আঘাত করে। পরে দোকানের ক্যাশ থেকে মাত্র ১,১০০ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার পর নিহতের পরিবার সদর মডেল থানায় হত্যা মামলা (মামলা নং-১৮/২০২৫, ধারা ৩০২/৩৪) দায়ের করে। মামলার তদন্তে নামে আসে রহস্যজনক এক সূত্র, একটি রক্তমাখা ২০ টাকার নোট।
পুলিশ সুপার আরো জানান, ঘটনাস্থল থেকে বেরিয়ে আসা সময় খুনি একটি অটোরিকশায় উঠে। চালক পরে জানান, তার যাত্রীর হাতে প্রচুর রক্ত ঝরছিল। সে রিকশাভাড়া দিতে একটি রক্তমাখা নোট দেয়। ওই তথ্যের ভিত্তিতেই পুলিশ হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ঘেঁটে হত্যাকারীকে শনাক্ত করে। তার হাতেও ব্যান্ডেজ ছিল, যা খুনের সময় আহত হওয়ার ইঙ্গিত দেয়। শনাক্ত হওয়ার পর দীর্ঘ অভিযান চালিয়ে ১৭ আগস্ট দুপুরে শ্রীমঙ্গলের লইয়ারকুল গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে জুহেলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার এম. কে. এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে, আর্থিক সংকটে হতাশ হয়ে জুহেল এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হত্যার দিন সে পুরো শহরে ঘুরে অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি দোকান খুঁজছিল। অবশেষে রুবেলের দোকানেই সুযোগ পেয়ে হামলা চালায়। গ্রেপ্তারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জুহেল হত্যার দায় স্বীকার করেছে। সে জানায়, ৬ আগস্ট প্রথমবার শহরে এসেও কোনো সুযোগ না পেয়ে ফিরে যায়। পরদিন আবার ফিরে এসে হার্ডওয়্যার দোকান থেকে কিছু পণ্য কিনে আশপাশে ঘোরাফেরা করে। পরে রুবেলকে একা পেয়ে ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করে। পুলিশ তার দেওয়া তথ্যমতে হত্যায় ব্যবহৃত ছুরি, ঘটনাস্থলে ব্যবহৃত মাস্ক ও জুতা, রিকশা ভাড়ায় দেওয়া রক্তমাখা নোট, হার্ডওয়্যার দোকান থেকে কেনা এলবো ও গ্লো উদ্ধার করে।
জুহেলের পারিবারিক অবস্থা ছিল শোচনীয়। বাবা দিনমজুর, নিজে বেকার। আগে স্থানীয় একটি মিষ্টির দোকানে কাজ করলেও চাকরি হারানোর পর হতাশায় ডুবে যায়। সেই হতাশা ও আর্থিক সংকট থেকেই অপরাধের পথে পা বাড়ায় সে।
নিহত রুবেল মৌলভীবাজার শহরের সুপরিচিত ব্যবসায়ী ছিলেন। হত্যার প্রতিবাদে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রেখে বিক্ষোভ করেন। জানাজায় অংশ নেন বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির স সাবেক সংসদ সদস্য এম নাসের রহমানসহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। তারা এ হত্যার নিন্দা জানিয়ে দ্রুত বিচারের দাবি করেন। ব্যবসায়ী মহলের দাবি, শহরে দিনে-দুপুরে ব্যবসায়ী খুন হওয়া নিরাপত্তাহীনতার বড় প্রমাণ। দ্রুত বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।