জীবিত মালের চেয়ে মৃত সাইফুর শক্তিশালী ll সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব
প্রকাশিত হয়েছে : ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৬:১১ অপরাহ্ণ
[এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৬ সালে সাপ্তাহিক পূর্বদিক পত্রিকায়। সাবেক মন্ত্রী, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ জনাব মরহুম এম সাইফুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে পূর্বদিক সে সময় একটি ক্রোড়পত্রও বের করে। পূর্বদিক অনলাইনেও লেখাটি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু ওয়েবসাইটে ত্রুটির কারণে লেখাটি মিসিং হয়। ৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ইং বরেণ্য রাজনীতিকের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর স্মৃতির সম্মানে লেখাটি আবার পূণর্মুদ্রণ করা হলো- সম্পাদক।]
এ কথা অনস্বীকার্য যে সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান রাজনীতিতে উন্নয়নের যে নজির স্থাপন করেছিলেন সমকালীন আর কেউ তার মতো তেমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেন নি। রাজনীতিকে তিনি উন্নয়নের স্বার্থেই গ্রহণ করেছিলেন। অরাজনৈতিক সাইফুর রহমানকে যখন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বিএনপির রাজনীতির জন্য আহবান জানান তখন তিনি সিলেটের উন্নয়নের শর্ত জুড়ে দেন। জিয়াউর রহমান তাঁর শর্ত মেনে নিলে রাজনীতিতে এম সাইফুর রহমানের অভিষেক হয়। উন্নয়নের রূপকার কথাটি সাইফুর রহমানের পাশে খুব যুৎসই। বিশেষত সিলেটের উন্নয়নের ক্ষেত্রে। তৎকালে ও একালে সাইফুর রহমানের তুলনায় বাকীরা সিকি পার্সেন্ট। কথাবার্তায় ছিলেন স্পষ্টভাষী। তার বক্তব্য বিবৃতিতে কোন ধরনের ধামাচাপা বা লুকোচুরির মিশেল ছিল না। যেটা বিশ্বাস করতেন, মনে প্রাণে লালন করতেন তাই তিনি বলে ফেলতেন। বর্তমান আওয়ামী সরকারের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এ পর্যন্ত যতটা উন্নয়ন করতে পেরেছেন তার তুলনায় মৃত সাইফুর রহমান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এখনো অনেক এগিয়ে আছেন। বলা যায় জীবিত আবুল মালের চেয়ে মৃত সাইফুর রহমানই বেশি শক্তিশালী।
বিএনপি সরকারের আমলে দ্রব্য মূল্যের দাম বেড়ে গেলে সাধারণ মানুষেরা বেকায়দায় পড়ে। তখন মৌলভীবাজারে এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন. ‘বেগুন তো আর মেশিনে তৈরি হয় না। বাড়ীতে বেগুন গাছ লাগিয়ে বেগুন খাওয়া যায়’। যদিও কেউ কেউ কথাটাকে রসিকতা মনে করেছিলেন। কিন্তু এখানেই সাইফুর রহমানের উন্নয়নের দর্শন লুকায়িত ছিল। উৎপাদনকে তিনি গুরুত্ব দিতেন। আজ মৌলভীবাজারে যে ফিসারি বিপ্লব হচ্ছে তারও পথিকৃৎ সাইফুর রহমান। সাইফুর রহমান কপটতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন বড় মাপের একজন দার্শনিক। এজন্যই তিনি মনে করতেন, রাজনীতির জন্য যা ভালো অর্থনীতির জন্য তা ভালো নাও হতে পারে। তাঁর উন্নয়ন নীতিতে রাজনীতি প্রবেশ করেনি। তবে তাকে অনেকেই আঞ্চলিকতার দোষে দুষ্ট মনে করেন। আর এটি করেন সিলেটে বেশি উন্নয়ন করার কারণেই। তবে এটি সর্বাংশে সত্য নয়। নিজের এলাকার প্রতি তাঁর দরদ থাকা সত্ত্বেও পুরো দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতির চাকাকে তিনি সচল করতে চেয়েছেন।
আজকে বাংলাদেশে যে উন্নয়নের ধারা প্রবাহমান আছে তা মরহুম এম সাইফুর রহমানের হাত ধরেই যাত্রা শুরু করেছে। নিজস্ব চিন্তা চেতনা ও অপরিসীম মেধার জোরেই দেশের উন্নয়নের জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি আবিস্কার
করতেন। বাংলাদেশে প্রথম মূল্য সংযোজন ভ্যাট চালু করে দেশের টাকায় দেশ পরিচালনার যে আইডিয়া এটি তাঁর। বর্তমান সরকারের আমলে এটি এখন একটি ফলপ্রসূ আয়ের ভিত্তি। রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে উন্নয়নকে আলাদা করে দেখার কারণেই মরেও অমর হয়ে আছেন এম সাইফুর রহমান। সে সময়েও বিএনপির অন্য নেতারা যখন মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে গাছেরটা ও তলেরটা খাবারের মতলব করতেন তিনি ছিলেন তার বাইরে সম্পূর্ণ আলাদা ব্যক্তিত্ব। তার সততা, কর্মনিষ্টতা, সাহসিকতা ও স্পষ্টবাদিতার কারণে তাকে বিরোধীদলের বাইরে নিজ দলের অনেক নেতাই ভয় পেতেন। এমপি, মন্ত্রী, সচিব, আমলা-কামলা যে কেউ উল্টা পাল্টা করলে কিংবা ক্রুটি বিচ্যুতি করলে তিনি তা সামনা সামনি ধরিয়ে দিতেন। সংশোধন হতে বলতেন। এজন্য হয়তো ভেতরে ভেতরে অনেকেই তার বিরাগভাজন ছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পরে তারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন সাইফুর রহমানের মতো অভিভাবকতুল্য রাজনীতিক সকলেই হন না।
সিলেটের উন্নয়নে এম সাইফুর রহমানের পূর্বসুরী ছিলেন প্রাক্তন মন্ত্রী রিয়াল এডমিরাল এম এ খান, এম এ হক ও হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী। হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী জাতীয় পার্টির পররাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে যখন আওয়ামী লীগের স্পিকার হোন সাইফুর রহমান তখন বিরোধী দলের এমপি। তখন সিলেটের উন্নয়নের কথা বলায় সাইফুর রহমান তোপের মুখে পড়েন। তিনি সেদিন বলেছিলেন ‘বাংলাদেশকে সিলেট যা দিয়েছে তার তুলনায় কিছুই পায়নি। পঞ্চাশ বছর যদি সিলেট নিতে থাকে তবে দেয়ার তুলনায় সেটি কম হবে।’ সেদিন হুমায়ুর রশিদ স্পিকারের আসনে থেকে কিছু না বলতে না পারলেও সিলেটের একটি অনুষ্ঠানে এই বক্তৃতার জন্য সাইফুর রহমানে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন।
শুধু রাজনীতি আর উন্নয়নই নয় তার মধ্যে ছিল অকৃত্রিম দেশপ্রেম আর উন্নত আত্মমর্যাদাবোধ। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। এসএম হলের ছাত্র ছিলেন সাইফুর রহমান। তখন ভাষা আন্দোলনের দাবিতে ঢাবি ছিল উত্তাল। তার অপরাপর বন্ধুরা ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও তিনি কোন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মী ছিলেন না।
এই অরাজনৈতিক মেধাবি ছাত্র সাইফুর রহমান যখন দেখলেন পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা বাংলাভাষা নিয়ে ছলচাতুরি ও টালবাহানা শুরু করেছে তখন তিনিও জ্বলে উঠলেন। সুযোগ আসলো ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারিতে। সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচিতে প্রথম সারিতে ছিলেন তিনি। এ অপরাধে ২৫ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন সরকারের পুলিশ অন্যান্যদের সাথে তাঁকেও গ্রেফতার করে।
আন্দোলনের সফলতা যখন দ্বারপ্রান্তে তখন সরকার পড়লো বেকায়দায়। তারা গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের জেল থেকে বের করে দেয়ার ঘোষণা করলো। যারা মুচলেকা দিবে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হবে। তখন অনেকে মুচলেকা দিয়ে বের হয়ে আসলেও সাইফুর রহমান মুচলেকা দিয়ে বের হতে নারাজি প্রকাশ করেন। তিনি মনে করতেন, ভাষার দাবিতে সচিবালয় ঘেরাও করে তিনি কোন অন্যায় করেন নি। আর মুচলেকা দেয়ার মানে হচ্ছে দোষ স্বীকার করা। তিনি মুচলেকা দেন নি। স্বাভাবিক নিয়মে সাজাভোগ শেষে জেল থেকে বের হোন তিনি। এখান থেকে তার শিরদাঁড়া মানসিকতা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনের সংগ্রামী সৈনিকের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৫ সালে তিনি একুশে পদক লাভ করেন।
একজন সরলপ্রাণ রাজনীতিক এম সাইফুর রহমানের মৃত্যু সড়ক দুর্ঘটনায় মধ্য দিয়ে হয়। যে সড়ক-মহাসড়কে উন্নয়ন ও সংস্কারে তুলনাহীনভাবে কাজ করেছেন সেই সড়কই কেড়ে নিলো তার প্রাণ। দুর্ঘটনার মৃত্যু ইসলামি শরিয়তে শহিদী মৃত্যুর মর্যাদা পায়। হয়ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তাকে সমালোচনার বাইরে রেখে অর্জিত সম্মান অক্ষুন্ন রেখে দুনিয়া থেকে বিদায় দিতেই তার কুদরতি কলমে লিখে রেখেছিলেন। আল্লাহ তাঁকে বেহেশতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন।
লেখক: সালাহ্ উদ্দিন ইবনে শিহাব: সহযোগী সম্পাদক, সাপ্তাহিক পূর্বদিক।